এই ব্লগটি সন্ধান করুন

শনিবার, ১১ জুলাই, ২০২০

কৃষ্ণ ও তাকে নিয়ে অপপ্রচার

অনেকের দাবি হলোঃ



শ্রীকৃষ্ণ তার নিজ আপন মামী রাধার সাথে প্রেম করেছে, এমনকি ১৬১০৮টি মেয়েকে বিবাহ করেন, এই কেমন ঈশ্বর যে পরকিয়া লিপ্ত থাকে। আবার অনেকেই বলে, লক্ষ্মীদেবীর অংশ হলো রাধা, এই সূত্র তারা রাধাকৃষ্ণের প্রেম সত্য বলে ধরে নেই, অনেকে আবার হয়তো রাধাকে, শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী বলে ধরেও নেই।
এই প্রশ্নগুলো সচারচর মুসলমানরা সাধারন সনাতনী ব্যাক্তিদের করে থাকে, কিন্তু তারা এই প্রশ্নের গুলোর সম্মুখীন হলেও তাদেরকে সদুত্তর দিতে পারেনা, অনেক সময় এই প্রশ্নগুলো নিয়ে সাধারন সনাতনীরা হীনমন্যতা ভোগে এবং তারা নিজের ধর্মকে তখন ভ্রান্ত বলে মনে করতে থাকে। আজকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো।
এখন দেখা যাক রাধা কৃষ্ণের মামী কিনা?
আপনারা জানেন মামীর স্বামী হলো মামা, আর সেই মামা হলো মায়ের ভাই। মুমিনরা বলছে যে, রাধা কৃষ্ণের মামী। তাহলে রাধার স্বামীকে হতে হবে কৃষ্ণের মায়ের কোনো ভাই। এখন দেখা যাক রাধার স্বামী বলে যাকে বলা হয় সেই আয়ান ঘোষ, প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণের মায়ের ভাই কিনা।
কৃষ্ণের মা ছিলো দুইজন। জন্মদাত্রী দেবকী, আর পালক যশোদা। দেবকীর ভাই কংস, কংসের যেহেতু অন্য কোনো ভাই ছিলো না সেহেতু এই দিক থেকে কৃষ্ণের অন্য কোনো মামা থাকা সম্ভব নয়। বাকী রইলো যশোদা; কথিত রাধার কথিত স্বামী আয়ান ঘোষ যে যশোদার ভাই সেই ব্যাপারে শ্রীমদ্ভাগবত, যেটা শ্রীকৃষ্ণের প্রামান্য জীবনী এবং মহাভারত, যাতে কৃষ্ণের জীবনের অনেক কাহিনী আছে, এই দুটো গ্রন্থে কোনো তথ্য নেই। এছাড়া আয়ান ঘোষও যে একটা কাল্পনিক চরিত্র তার প্রমান তার ঘোষ পদবী দিয়ে।কারন কৃষ্ণের সময় ঘোষ পদবী বলে কিছু ছিলো না। এই ঘোষ পদবি মধ্যযুগের উৎপত্তি। সংস্কৃত ভাগবত এবং মূল মহাভারতে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের কোনো কথা উল্লেখ নেই।
তারপর দেখা যাক রাধা, লক্ষ্মীদেবীর অংশ কিনা?
হরিদাস সিদ্ধান্ত বাগীশ অনুবাদকৃত মহাভারতে বলা আছে,
"লক্ষ্মীদেবীর অংশ, শ্রীকৃষ্ণেরই প্রীতির জন্য পৃথিবীতে আসিয়া ভীষ্মকরাজার কন্যারূপে রুক্মিণী নামে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।।
(মহাভারতঃ আদিপর্ব, দ্বিষষ্টিতমোধ্যায় (৬২ অধ্যায়), শ্লোক ১৫৭)
সুতরাং, আমরা দেখতেই পাচ্ছি, রাধা কোনো লক্ষ্মীর অংশ নয়। একমাত্র লক্ষ্মীর অংশ হলো রুক্মিণী। তার মানে শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী হওয়ার যোগ্য রাখে শুধুমাত্র লক্ষ্মীদেবীর অংশ স্বয়ং রুক্মিণী ই। কারন যিনি রুক্মিণী তিনিই হলেন লক্ষ্মী এবং যিনি শ্রীকৃষ্ণ তিনিই হলেন নারায়ন। শ্রীকৃষ্ণই যে স্বয়ং নারায়ন, এই প্রসঙ্গে হরিদাশ সিদ্ধান্ত বাগীশ অনুবাদকৃত মহাভারতে বলা আছে,
" নারায়ন নামে যিনি সনাতন এবং দেবগনেরও দেবতা ছিলেন, তিনিই মর্ত্ত্যলোকে আসিয়া প্রতাপশালী কৃষ্ণরূপে জন্মগ্রহন করিয়াছিলেন।।
(মহাভারতঃ আদিপর্ব, দ্বিষষ্টিতমোহধ্যায় (৬২ অধ্যায়), শ্লোক ১৫২)
এরপর দেখা যাক শ্রীকৃষ্ণ কাকে বিবাহ করেছিলেন?
মহাভারত এর অনুশাসন পর্ব, অধ্যায় ১৪, শ্লোক ৭ এবং আদিপর্ব, অধ্যায় ৬২, শ্লোক ১৫৬ এখানে বলা আছে, শ্রীকৃষ্ণের ১৬০০০ স্ত্রী ছিলো। কিন্তু বাস্তবে এই শ্লোক গুলো প্রক্ষিপ্ত। কেননা মহাভারতের আগে মোট শ্লোক ছিলো ৮৪,৮৩৬। এখন বর্তমানে শ্লোক ১,০৭,৩৯০। যা বর্তমানে সময়ের সাথে সাথে অনেক গুলো শ্লোক প্রক্ষিপ্ত হয়েছে।
পুরান এর কাহিনি অনুসারে আমরা পাই, নরকাসুর থেকে শ্রীকৃষ্ণ এই ১৬০০০ মেয়েকে বন্ধি থেকে উদ্ধার করে বিবাহ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে অনেকে বলে সেই সময়ে সমাজে এইসব মেয়েদের বিবাহ দেওয়ার সম্ভব ছিলো না বিধায় তাই তাদেরকে শ্রীকৃষ্ণ বিবাহ করে নেই। কিন্তু বাস্তবে এইসব ঘটেও নি সেটার প্রমান আমরা নরকাসুরের জন্মের বৃত্তান্ত থেকেই জানতে পারবো।
বিষ্ণু যখন বরাহ অবতার রূপ ধারন করে জলমগ্ন পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিলেন, তখন পৃথিবী ও বরাহের সংস্পর্শে নরকাসুরের জন্ম, এই সূত্রে পৃথিবী মানে Earth হলো নরকের মা। এখন বলেন, বাস্তবে এটা কি সম্ভব? পৃথিবী কি মানুষ, যে সে সরাসরি কোনো মানব সন্তানের জন্ম দেবে?
নরকাসুরের জন্মের এই অবাস্তব কাহিনীই বলে দেয় যে, নরকাসুরের ঘটনা সম্পূর্ণ বানানো।
যদি কৃষ্ণ এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতো, তাহলে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময়, সেখানে উপস্থিত শিশুপাল, যে ছিলো কৃষ্ণের প্রধান শত্রু ও সমালোচক, সে কৃষ্ণ নিন্দার সময় এই ষোলহাজার একশ আটজন মেয়ের ঘটনার কথা অবশ্যই উল্লেখ করতো, কিন্তু শিশুপালও তা উল্লেখ করেনি, যেমন শিশুপাল উল্লেখ করেনি রাধার কথা। কারন, কৃষ্ণের জীবনে রাধা বলে যেমন কেউ ছিলো না, তেমনি তার জীবনে ১৬,১০৮ মেয়েকে উদ্ধার ও বিয়ে করার ঘটনাও ঘটেনি। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী একমাত্র রুক্মিণী ছিলেন, তাই সেই সময় শিশুপাল একমাত্র রুক্মিণী দেবীর কথা উল্লেখ করেছিলেন, শুধুমাত্র রুক্মিণী ই হলেন শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী।
যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময় শিশুপাল এর শ্রীকৃষ্ণের নিন্দার সময়, শ্রীকৃষ্ণ বিদর্ভরাজ ভীষ্মক এর কন্যা রুক্মিণী কে তার সম্মতিতে হরন পূর্বক বিবাহ করেন। কারন রুক্মিণীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে শিশুপালের সহিত বিবাহ দেওয়া হচ্ছিলো। মহাভারতের সভাপর্বে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করে শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
"এই মুমূর্ষু মূর্খটার রুক্মিণীকে লাভ করিবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু শুদ্র যেমন বেদবাক্য শুনিতে পারে না, এ মূর্খটারও তেমন রুক্মিণীকে লাভ করিতে পারে নাই। কিন্তু প্রতাপশালী শিশুপাল কৃষ্ণের সেই কথাগুলি শুনিয়া অট্ট হাস্য করিলেন এবং এই কথা বলিলেন।" (মহাভারতঃ সভাপর্ব, অধ্যায় ৪৪, শ্লোক ১৫-১৬)
এরপর শিশুপাল কৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
"কৃষ্ণ! সভার মধ্যে বিশেষতঃ বাজাদের সমক্ষে রুক্মিণী পূর্বে আমার পরিগৃহীত ছিলেন এইরূপ বলিতে তোমার লজ্জা হইল না কেন? (মহাভারতঃ সভাপর্ব, অধ্যায় ৪৪, শ্লোক ১৮)
" কৃষ্ণ! তুমি ভিন্ন অন্য কোন পুরুষ সভার মধ্যে নিজের স্ত্রীকে অন্যপূর্ব্বা জানিয়া তাহা কীর্ত্তন করিয়া থাকে। (মহাভারতঃ সভাপর্ব, অধ্যায় ৪৪, শ্লোক ১৯)
এখানে আমরা দেখতেই পাচ্ছি, একমাত্র দেবী রুক্মিণী যে একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী, তা শিশুপাল ও শ্রীকৃষ্ণের এই দুইজনের কথনে, শিশুপাল তা নিজেই স্বীকার করেছেন।
এছাড়াও মহাভারতের আরেকটা শ্লোক এ বলা আছে,
"শ্রীকৃষ্ণ নিজের পত্মি রুক্মিণীর সাথে হিমালয়ে ১২ বছরের মহান ঘোর ব্রহ্মচর্য ব্রত ধারন করে তপস্যা করেছিলেন। দুইজনে সনত্ কুমারের ন্যায় তেজস্বী পুত্র প্রদ্যুম্ন নামক পুত্র উৎপন্ন করেছিলেন।" (মহাভারতঃ সৌপ্তিক পর্ব, অধ্যায় ১২, শ্লোক ৩০-৩১)
এই শ্লোক থেকে আমরা দেখতেই পাচ্ছি, শ্রীকৃষ্ণের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন রুক্মিণীদেবী, যিনি ছিলেন পরম ধার্মিক, বিদুষী ও পতিব্রতা। সন্তান জন্মদানের পূর্বে তাঁরা উভয়েই বদরিকাশ্রমে যান ও দীর্ঘ বারবছর কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করেন। এরপর রুক্মিণীদেবী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন যার নাম রাখা হয় প্রদ্যুম্ন।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমানিত যে, শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী বলতে ছিলেন একমাত্র স্বয়ং রুক্মিণীদেবী। ১৬,১০৮ টি মেয়ে ও রাধা নিয়ে যা গল্প রয়েছে, তা আজাগুরি অবাস্তব গল্প মাত্র। সেই হেতু রাধা কোন শ্রীকৃষ্ণের মামী নয়, এমনকি প্রেমলীলা তা কোনোদিন ঘটেও নি।
ॐ শ্রী পরমাত্মানে নমঃ
:সংগৃহীত
🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏

Bikash sarker

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন